আজকে লিখতে ইচ্ছা করছে পেন্সিল এর এক মডারেটরকে নিয়ে। পেন্সিলের মডারেটর হওয়ার চেয়েও যেটা আমার কাছে আরও অনেক বড় ; সেটা হচ্ছে দীপা আমার ক্লাসমেট (ছিল) এবং বান্ধবী। দীপাকে দীপাবলীও বলা যায়। অন্তত আমার জন্য তো অবশ্যই।
ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া, সেময় আমার জন্য অতি ও অত্যন্ত সহজ কাজ ছিল। সে বিষয়ে তখন বোধহয় আত্মবিশ্বাস আর সাহস ও একটু বেশীই ছিল। আর কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার কোন প্রয়োজনই মনে করি নাই। ভর্তি পরীক্ষায় ২৭তম হলাম। যেকোন বিষয়েই ভর্তি হতে পারতাম। চোখ, মুখ, নাক, কান বন্ধ করে ভর্তি হলাম অর্থনীতিতে। (তখন অর্থনীতি ছিল আমার কাছে খুবই সহজ আর মজার একটা বিষয়।) ভাগ্যিস ভর্তি হয়েছিলাম, তা নাহলে দীপাকে কোথায় পেতাম? ও তো সেই অর্থনীতিতেই ভর্তি হয়েছিল।
আমাদের ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রী ছিল ১২০-১৫০। (রেন্জটা বেশ বড় বুঝতে পারছি কিন্তু এত বছর পর এ্যাকুরেট সংখ্যা বলা মুশকিল হচ্ছে। বন্ধু/বান্ধবদের সাহায্য নিয়ে মিনিমাম-ম্যাক্সিমাম উল্লেখ করলাম)। বিশাল ক্লাস। আমাদের সবার মধ্যে কমন কিছু বিষয় ছিল। সবাই খুব মেধাবী। যে যেখান থেকেই আসুক। প্রচন্ড মেধা তাদের সবার। তার প্রমান দিয়ে তারা অর্থনীতি বিভাগে জায়গা করে নিয়েছে। ক্লাসের একটা বড় অংশ ছিল বিভিন্ন বোর্ড থেকে মেধা তালিকায় স্ট্যান্ড করা।সবাই খুব সিরিয়াস টাইপ। এমনকি দুষ্টু ছেলেমেয়ে গুলিও খুব সাবধানে কাউকে বিরক্ত না করে দুষ্টুমি করে। প্রায় সবাই বয়সের তুলনায় বেশী গাম্ভির্য দেখিয়ে ফেলত। এসবের মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভূত কমন বিষয়টা ছিল গ্রুপ হয়ে চলা। কেউ নিজের গ্রুপ ছাড়া অন্য কারো সাথে তেমন একটা কথাবার্তাও বলত না।গ্রুপের বাইরে পূর্ব পরিচিত হলে কিছু কথাবার্তার চল ছিল। সবার সাথে কথা বলছে এরকম কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার।
শুরু থেকেই নানারকম গ্রুপ তৈরী হয়ে গেল। সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডদের গ্রুপ, একই স্কুলে-কলেজে পড়াদের গ্রুপ, ঢাকার বাইরে থেকে আসাদের হল ভিত্তিক গ্রুপ, দুষ্ট ছেলেদের গ্রুপ, দুষ্টু মেয়েদের গ্রুপ, মুখচোরা ছেলে এবং মেয়েদের আলাদা গ্রুপ।
বলা বাহুল্য, আমিও একটা গ্রুপে বিলং(belong) করতাম। সদস্য ছিলাম মুখচোরা মেয়েদের গ্রুপের। সেসময় আমি ছিলাম পুরোপুরি মুখচোরা (এখন আংশিক)। আমি খুব মুখচোরা হলেও কিভাবে বা কেন যেন মানুষ আমার সাথে নিজে থেকে আগ্রহ নিয়ে কথা বলত এবং এখনও বলে। আল্লাহ তাদের ভাল করুন। (ভাগ্যিস এরকম মানুষ আছে। তা নাহলে আমি একা একাই জ্বীনের মত ঘুরে বেড়াতাম।)
আমি এবং আমার বান্ধবীরা নিজেদের মত থাকি। আমাদের এমন একটা ভাব, “আমরা তোমাদের দিকে তাকাই না। প্লীজ তোমরাও আমাদের দিকে তাকাবা না” ব্যক্তিগত ভাবে আমার অবস্হা অনেকটা এরকম যে পারলে টেবিলের তলায় বসে থাকি যেন কেউ আমাকে না দ্যাখে। আমার সুপার উইমেনও হতে ইচ্ছা করত। ইনভিজিবল উইমেন জাতীয় কিছু একটা।
এবার আসি দীপার কথায়। দীপা স্বভাবের দিক থেকে আমার উল্টা। সবার সাথে কথা বলত, হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকত। সহজ, সাবলীল হাসিখুশী একটা মেয়ে। সবার সাথে এমন ভাবে মিশত যে এমনকি এটাও মনে করতে পারছি না যে দীপা কোন গ্রুপের সদস্য ছিল কিনা। আমি মুখচোরা হলেও চোখ তো খোলাই থাকত। দীপাকে দেখতাম সবার সাথে। ওর ঘটনাটা কি বুঝতে পারতাম না। ও সবার সাথে কি করে তাও এক রহস্য!?
ফার্ষ্ট ইয়ারে শেষের দিকে অথবা সেকেন্ড ইয়ারের শুরুর দিকে দীপা আমাকে আবিষ্কার করে ফেলল। দীপা যেহেতু সবার সাথে মিশত ওর পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না যে আমার সাথে অনেক সময় কাটাবে। তাছাড়া তেমন কোন কারনও ছিল না আমার সাথে অনেক সময় কাটানোর। মাঝে মাঝে ওর সাথে কথা হোত। মাঝে মাঝে কথা বলা থেকেই বুঝতাম, দীপা সবার থেকে আলাদা। ওর সবার থেকে আলাদা হওয়ার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই।
দীপা মাঝে মাঝে পাবলিক বাসে উঠত। পাবলিক বাসে উঠা কি রকম ঝক্কি ঝামেলা সেটা ভুক্তভোগীরাই জানে। মানুষের তৈরী করা কিছু যন্ত্রনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য দীপা হাতে ছুরি রাখত। বিল্ডাররা যে ছুরি ব্যবহার করে সেটা। ওর ছুরিটা ছিল স্ন্যাপ অফ ব্লেড (Snap off blade knife)। নীরিহ ধরনের এ ছুরিটা একটু খুললেই আর নীরিহ থাকে না। দীপা সেটাকে কিছুটা খুললেই বাসের গেট ওর জন্য পরিষ্কার।সব নষ্ট মানুষ গুলি তখন বেশ কিছুটা কষ্ট নিয়ে হলেও ক্ষনিকের জন্য ভাল হয়ে যেত। ওঁকে কিছুই করতে হোত না। হাতে শুধু ছুরিটা ধরে রাখা। দীপা সেফ অ্যান্ড সিকিউর। এরকম ভাবনা হয়ত অনেকের মাথায়ই থাকতে পারে কিন্তু এটাকে কাজে পরিনত করা (অন্তত সেসময়) সবার পক্ষে সম্ভব না।
আমাদের, ভার্সিটি তে বন্ধু হয়ে সময় কাটানোর মোট সময়কাল খুবই স্বল্পধৈর্ঘ্য বা বিচ্ছিন্ন ধরনের কারন থার্ড ইয়ারের শুরুতেই আমার একটা এ্যাকসিডেন্ট হওয়ায় মাষ্টার্স এর আগে আমি আর ভার্সিটিতে কোন ক্লাসে যেতে পারিনি। দীপা অবশ্য বাসায় আসত আমাকে দেখতে। (মাষ্টার্সে আমরা দুজনই কিছুটা অনিয়মিত ছিলাম।)
দীপার ভাষায় ও ছিল দুষ্টু, পাজী আর ফাঁকিবাজ। আসলে ও ছিল খুব স্মার্ট আর বহুমুখী মেধার অধিকারীনি। তবলা বাজাত। সেই সময় তো বটেই এখন পর্যন্ত আমি কোন মেয়ে/মহিলাকে তবলা বাজানোকে প্যাশন হিসেবে নিতে দেখিনি। বর্তমানে দীপার তবলা বাজানোর প্রতিভায় বারবার মুগ্ধ হয় অষ্ট্রেলিয়ার বাঙ্গালী প্রবাসীরা।
দীপা কিছুটা দুষ্টু ছিল এটা স্বীকার না করলে মিথ্যা বলা হবে। কিন্তু ওর দুষ্টামি ছিল নির্দোষ ধরনের। দীপার কিছু কথা মনে হলে আমার অন্তরটা হেসে উঠে। বুঝতে পারি আমার ঠোঁটের কোনে হাসি। ও যে শুধু হাসি, ঠাট্টা আর দুষ্টামি বুঝত তা না। আমার এ্যাকসিডেন্টকে কেন্দ্র কর ওঁকে আমি যথেষ্ট সিরিয়াস হতে দেখেছি।
অনার্স পরীক্ষার পর পরই অর্থনীতির ছাত্র-ছাত্রীদের দৌড় শুরু। বি সি এস, উন্নত পড়ালেখার জন্য বিদেশ যাওয়া, বিয়ে করে সংসার গুছানো, প্রাইভেট সেক্টরে চাকরী ইত্যাদি নিয়ে সবাই ব্যস্ত। প্রায় সবার জীবনেই ট্রানজিশন চলছিল। সেসময়টাতে শুরু হলো মাষ্টার্স এর ক্লাস। আমি কিছুটা সুস্হ হলেও চারতলায় উঠানামা খুব কঠিন হয়ে পড়ত। অনিয়মিতভাবে যেতাম। দীপাও কিছুটা ব্যস্ত, অনিয়মিত, হাতে মোবাইল। মোবাইল কনসেপ্ট বাংলাদেশে তখনও নতুনই বলা যায়। ( সেসময় শুধু বিশেষ মানুষরাই মোবাইল ব্যবহার করত।) দীপার হাতের মোবাইল ওঁকে শুধু বিশেষ করেনি সাথে ওর প্রতিভা, মেধা আর স্মার্টনেস এর প্রমানও দিয়েছে। দীপা তখন কাজ করছিল গ্রামীন টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড এর ডেপুটি ম্যানেজার হিসেবে।(৫ বছরের জন্য)।
মাষ্টার্স এর পর সবার ট্রানজিশন আরও বাড়ল। আমরা প্রায় সবাই সবাইকে হারিয়ে ফেললাম ( কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ) দীপা বলে কথা, কয়েক বছর আগে আমাকে ঠিকই বের করে ফেলেছে ফেসবুকে। আমি তো মহাখুশী। দেখা হওয়ার সুযোগ নাই। কঠিন ও ভয়াবহ দূরত্ব। ইংল্যান্ড-অষ্ট্রেলিয়া। তো ফেসবুক ই সম্বল।
দীপার জীবনটা স্বাভাবিক গতিতে চলতে চলতে কঠিন সব ঝড় ঝাপটার মুখামুখি ও হয়েছে। সে অবস্হায় অনেকেই হয়ত জীবনের সব আশা ভরসা ছেড়েই দিত। দীপা তো আর সবার মত না। নতুন করে শুরু করেছে জীবনের গল্প। অনেক কাজ, ব্যস্ততা, মিষ্টি মেয়ে সাফিনা আর স্বামী সংসার দিয়ে সাজানো ওর জীবন। (মাশাল্লাহ।)
দীপার কাজকর্মের লিষ্ট অনেক লম্বা। শুরুটা বলেছি, বর্তমান সময়েরটা বলি। এল জে হুকার (রিয়েল এস্টেট) কোম্পানীতে সিনিয়র প্রপার্টি ইনভেষ্টমেন্ট ম্যানেজার সে। পেশাগত কাজ ছাড়া দীপা বেশ নামকরা তবলাবাদিকা। বিভিন্ন বাংলা অনুষ্ঠানের অর্গানাইজার, শিল্পী, উপস্থাপিকা। তাছাড়াও পেন্সিলের একজন মডারেটর।
কিছুদিন আগে দীপাই আমাকে পেন্সিলের সাথে পরিচিত করেছে এবং সেই সূত্র ধরে আজকে আমার পেন্সিলে লেখা। দীপা এবং দীপার মত দীপাবলীরা আল্লাহর রহমত, বরকত আর আশীর্বাদ এর মধ্যে থাকুক সারাজীবন।আমীন।
লেখকঃ তাসনুভা সোমা
ইংল্যান্ড প্রবাসী