পদ্মাসেতু প্রস্ততকারণ প্রতিষ্ঠানের এক চীনা
কর্মকর্তা কাজ দ্রুত এগিয়ে নেয়ার জন্য তার অধীনস্ত বাংলাদেশি কর্মকর্তাকে বললেন,
উই ওয়ান্ট মোর হেড। এখানে হেড বলতে কর্মী বুঝানো হয়েছে। কিন্তু
বাংলাদেশি কর্মকর্তা একধাপ এগিয়ে ‘হেড’ শব্দের অর্থ
মাথা বা কল্লা বুঝে মানুষের মাথা সংগ্রহে লেগে গেলেন। আর এভাবে গুজব নামে আজিব
শব্দটি ছড়িয়ে পড়লো’ না এটা আবার আপনারা সত্যি বলে ধরে নিয়েন না যে
এভাবেই গুজবের জন্ম হয়েছে। এটা একটা স্রেফ জোকস। পদ্মাসেতু নিয়ে কল্লাকাটা গুজব
নিয়ে নতুন সৃষ্ট জোকস। হয়তো অনেকে ভাববেন যে এরকম একটা সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে জোকস
করছি কেন? ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়।
যাক এবার আসল কথায় আসি। বড় কোনো স্থাপনা তৈরি
করতে জলদেবতা বা স্থলদেবতা নাকি মানুষের কল্লা চায়। আর এভাবে কালক্রমে মানুষের
অশিক্ষাকে পুঁজি করে একশ্রেণির চতুর মানুষ নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সমাজে
কুসংস্কারগুলো চালু রাখে।
মাঝখানে অবশ্য এধরনের গুজব মানুষ ভুলেও
গিয়েছিল। এমনকি যমুনা সেতু বা লালন সেতুর মতো বড় বড় সেতু তৈরির সময়ও এ ধরনের কোনো
গুজব শোনা যায়নি। প্রশ্ন হলো তখন কি জলদেবতা ঘুমিয়ে ছিল?
এখন কেন এমন গুজব তৈরি হচ্ছে? এ
নিয়ে নানা ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। সব কথার সারমর্ম বিচার করলে এটাই আমার কাছে
স্পষ্ট হয় যে, দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করাই আসল
উদ্দেশ্য বলে মনে হচ্ছে। আর এতে তারা সার্থকও হয়েছে। কেননা এপর্যন্ত বেশ কিছু নারী
পুরুষ ছেলেধরা গুজবের বলি হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। হয়তো প্রিয়জন হারানোর ব্যথা নয়,
দেশের সরকার ব্যর্থ এ সংবাদেই তারা আত্মতুষ্টি পাচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে- ২০১৮ সালে সারাদেশে
গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন। এ বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা
৩৬।
এর পর আসা যাক এ গুজব ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে
কেন? থামানো যাচ্ছে না কেন? এর কারণ হিসেবে মনে হয় এর ফাঁকে কিছু
ধুরন্ধর ব্যক্তি নিজ স্বার্থে কিছু প্রতিশোধ নিতে গিয়ে গলা কেটে হত্যা করেছে এবং
দুর্ভাগ্যক্রমে তার ধরা খেয়েছে আর গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এতে ডিজিটাল যুগে এ
খবর দ্রুত পৌঁছে গেছে মানুষে কাছে। আর এটা আরো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে বিশেষ করে
১৮ জুলাই ছয় থেকে সাত বছর বয়সী শিশুর কাটা মাথা ব্যাগে নিয়ে ঘোরাফেরা করার সময়
নেত্রকোণা শহরের নিউ টাউন এলাকায় অজ্ঞাত এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিক্ষুব্ধ
জনতা।
গুজবটা এত মানুষের মাথায় জেঁকে বসেছে যে কাউকে
সন্দেহে হলেই কোনো কিছু না বুঝেই তাকে উৎসব সহকারে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। আর কিছু
মানুষ সেটার ভিডিও করে ফেসবুকে ভিউ বাড়াতে সদা ব্যস্ত।
সর্বশেষ যে হৃদয় বিদারক ঘটনা তা হলো বাড্ডায়
তাসলিমা বেগম নামে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন এক অভিভাবককে ছেলেধরা গুজবের তীক্ষ্ণ
ছুরিতে ফালা ফালা করে হত্যা করা হয়েছে। তার শিশুদের এতিম করা হয়েছে। এই ঘটনা
সবাইকে নাড়া দিয়েছে।
আবার প্রশ্ন হলো কেন তারা এমন আগ্রাসী হয়ে উঠল।
সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি আস্থাহীন
হলে এমনটা ঘটতে পারে।
যদি কাউকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ হয়েই থাকে,
তবে তাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার কথা। মানুষের এ বোধ
কেন হারিয়ে গেল? তবে কি মানুষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথা বিচার
ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না? তারা দেখছে- অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর
গলিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই বিচারের ভার নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে।
সরকার কিছুটা দেরিতে হলেও গুজব ঠেকাতে মাঠে
নেমেছে। এখন সামাজিক মাধ্যমে ‘স্ট্যাটাস’ দিয়ে গুজব ছড়ানো
হচ্ছে। তাই গুজব রটনাকারীদের খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। তারপরও কেন তাদের চিহ্নিত
করা হচ্ছে না- তা বুঝা যাচ্ছে না। সরকারের বিরুদ্ধে কেউ সামান্য কিছু কটূক্তি করলে
বা কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও করা হয়। এ ক্ষেত্রে কেন কালক্ষেপণ করা হচ্ছে?
খুবই সাধারণ একজন জনগণ হিসেবে আমার দাবি,
দ্রুত এসব গুজব রটনাকারীকে প্রতিহত করুন। আর রক্ষা করুণ নিরীহ কিছু
মানুষের প্রাণ। তা না হলে দায়ভার কিন্তু দেশ পরিচালনাকারীদের কাঁধেই চাপবে।
লেখক: মোমিন স্বপন, সাংবাদিক ও নাট্যকার