বাংলাদেশে সম্প্রতি যেসব ভয়াভহ ধর্ষণ ও খুনের কাহিনী শুনছি তাতে শুধু আমি কেন, পুরো জাতি রীতিমতো উদ্বিগ্ন।দ্রস্টান্তমুলক শাস্তির দাবী, শোক ও নিন্দা জ্ঞাপন তো করা যায়ই, কিন্তু এ থেকে পরিত্রানের উপায় নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। Prevention is better than cure (নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ বা সতর্কতা ভালো)। তাই আমি মনে করি যদি আমরা কিছু নিয়ম মেনে চলি তাহলে হয়তো এই ধরনের ক্ষতি খুব কম হবে ইনশাল্লাহ।
(১) উন্নত দেশের মতো (যেমন অস্ট্রেলিয়া) কখনও আপনার বাচ্চাকে (ছেলে হোক, মেয়ে হোক, একই নিয়ম) (অন্তত পক্ষে ০-১৬ বছর পর্যন্ত) একা কোথাও ছাড়বেন না, যেতে দেবেন না, বা পাঠাবেন না। বিশেষ করে বাজারে বা দোকানে বা স্থানীয় খেলার মাঠে। যদি একান্ত যেতেই হয়, আপনিও সাথে যান।
(২) স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসায় নিজে দিয়ে আসবেন ও নিয়ে আসবেন (স্বামী -স্ত্রী কাজ ভাগ করে নেন)। মনে রাখবেন দুনিয়ার কিছুই আপনার বাচ্চার চেয়ে বেশী মূল্যবান না। স্কুলের নির্ধারিত সময়ের বাইরে স্কুলে যেন কখনও আপনার বাচ্চা একা কারও সাথে না থাকে। একান্ত প্রয়োজন হলে আপনি থাকুন তার সাথে।
(৩) বাসার কাজের লোক বা টিউটরকে চোখে চোখে রাখুন ও তাদের ব্যাবহার লক্ষ্য করুন। শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করে অনেক সময় বাচ্চাকে বলা হয়, এটাই নরমাল, কাউকে বলো না। তাই, বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করুন কেউ তার সাথে এবনরমাল ব্যাবহার করেছে কিনা (কোথাও ছুয়েছে কিনা বা কিছু করেছে কিনা)। জানতে পারলে সাথে সাথে ব্যাবস্থা নিন।
(৪) বাসায় বাচ্চাকে একা রেখে ১ মিনিটের জন্যেও কোথায় যাবেন না। একান্ত যেতে হলে, সাথে করে নিয়ে যান। ১ মিনিটেই অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে (যেমনঃ কিডন্যাপ হয়ে যেতে পারে, অন্য কোথাও নিয়ে ধর্ষণ করতে পারে, ইত্যাদি)।
(৫) কারও (সে যেই হোক – আত্মীয় বা প্রতিবেশী) বাসায় খেলতে বা রাতে থাকতে পাঠাবেন না। যদি একান্ত পাঠাতেই হয় তবে আপনি সাথে যান। যেটুকু সময় সে খেলবে, আপনি লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করুন। রাতে থাকলে আপনিও থাকুন। এমনকি নিজের কাছের আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকেও সতর্ক থাকতে হবে।
(৬) অন্য যে কারও থেকে আপনার বাচ্চাকে বেশী বিশ্বাস করতে শিখুন। বাচ্চা যদি বলে কেউ তাকে ব্যাথা দিয়েছে তবে তা সিরিয়াসলি নিন। আপনার বাচ্চার উপর আপনি আপনার আত্মীয়, তার শিক্ষক বা মাদ্রাসার হুজুরকে বেশী বিশ্বাস করবেন না (তার শিক্ষার চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশী)। বেশীরভাগ শারীরিক লাঞ্চনা অত্যন্ত নিকট আত্মীয়দের দ্বারাই সংগঠিত হয়। সেরকম কিছু চোখে পড়লে সাথে সাথে তাকে এক্সপোজ করুন (সোসাল মিডিয়া, মিডিয়া বা পুলিশে জানান)। নাহলে সে অন্যদের সাথেও এই কাজ করতে থাকবে।
(৭) আপনার বাচ্চার সাথে (তার বয়স অনুযায়ী) গ্রহনযোগ্য ব্যাবহার নিয়ে কথা বলুন। তাকে শিখিয়ে দিতে হবে যে শরীরের কোন অংশেই অন্য কারও স্পর্শ গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন অনেকে খেলার ছলে শুধু গালে নয়, শরীরের অন্য জায়গায়ও চুমু খায় – এগুলা ঠিক নয়। এরকম হলে যেন সে আপনাকে জানায়। তাকে বলতে হবে যে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সে তো কোন অপরাধ করেনি। আপনি যদি একবার অযথা আপনার বাচ্চাকে দোষী করেন – যে এগুলা হয়ই, উনি তোমার আঙ্কেল, ইত্যাদি – আপনার বাচ্চা হয়তো জীবনে আর কখনোই আপনাকে কিছু বলবে না।
(৮) আপনার বাচ্চাকে শিখিয়ে দিতে হবে যে কেউ যদি শারীরিকভাবে এসল্ট করে তাকে হুমকি দেয় (এই ঘটনা কাউকে বললে তোমার বাবা-মা কে মেরে ফেলবো, তোমাকে মেরে ফেলবো, বা কুরআন ধরে বলো কাউকে বলবে না, না বললে চকোলেট দিবো, ইত্যাদি) তবুও যেন কিছুই আপনার কাছ থেকে না লুকায়
(৯) আপনার বাচ্চাকে আপনার অনুপস্থিতিতে অন্যদের কাছ থেকে চকোলেট, টাকা, আইসক্রিম ইত্যাদি না নিতে উৎসাহিত করুন। তাহলে সে অন্যদের ট্র্যাপ থেকে বেঁচে যাবে। বেশীরভাল পেডোফাইলরা এগুলার মাধ্যমে বাচ্চাদের কাছে এক্সেস পায়।
(১০) বয়স অনুযায়ী আপনার বাচ্চাকে সুন্দর পরিবেশ দিতে হবে – তাকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে (যেমনঃ তার শরীর কোন লজ্জার বিষয় নয়, বয়ঃসন্ধিকাল একটা নরমাল বিষয়, ইত্যাদি)। তাকে কনফিডেন্স দিতে হবে। তাছাড়া অনেক সময় বাবা-মার ঝগড়ার কারনে অনেক সময় বাচ্চারা ডিপ্রেশনে থাকে। অনেক সময় প্রিডেটররা বাচ্চাদের ডিপ্রেশনের সুযোগ নেয়। ভালো কথায় প্রলোভনে তারা ফেসে যায়। সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের সামনে ঝগড়া না করাই শ্রেয়। হয়ে গেলেও পরে বাচ্চাকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে।
(১১) সবারই আত্মরক্ষা বিষয়ে জ্ঞান থাকা উচিত। পারলে আপনার বাচ্চাকে আত্মরক্ষা কৌশল শিক্ষা দিন। (যেমনঃ প্রতি সপ্তাহে মার্শাল আর্টস, বা শুধু বাৎসরিক আত্মরক্ষা ট্রেনিং)। একান্ত না পারলে ইউটিউব ভিডিও দেখে শিখে নিতে পারে। আপনি তাকে সাহায্য করুন।
(১২) আপনার বাচ্চা কাদের সাথে মিশছে তা লক্ষ্য রাখুন। সে যেন ড্রাগ এডিক্টেড কারও সাথে না মিশে। তাকে ড্রাগের ভয়াবহতা নিয়ে (বয়স অনুযায়ী) তথ্য দিন। টাকা পয়সা দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করুন। অন্যথায় একবার হয়ে গেলে ফিরিয়ে আনা মুশকিল।
(১৩) আপনার বাচ্চার অনলাইন এক্টিভিটি লক্ষ্য রাখুন। কোনভাবেই যেন সে অনলাইনে বেশী সময় না কাটায়। ১৩ বছরের নীচে বাচ্চাদের মোবাইল ফোন থাকা উচিত না। বাসার কম্পিউটারেও “পেরেন্টাল” অপশন বেছে নিয়ে তার অনলাইন এক্টিভিটি রেস্ট্রিক্ট করে দিন। অনলাইনে যেন সে পর্ণ এডিক্ট না হয়ে যায় বা কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ঘর ছেড়ে না পালায় বা ডেটিং এ না যায়।
(১৪) আপনার বাচ্চাকে মারধর করা থেকে বিরত থাকুন। কোন ভুল করলে বোঝান বা অন্য কোন পদক্ষেপ নিন (যেমনঃ এক সপ্তাহের জন্যে পকেট মানি বন্ধ, গ্রাউন্ডেড (বাইরে যেতে পারবে না), বা তার প্রিয় জিনিষ না দেয়া – একান্ত ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে নটি কর্নার (দুস্ট কর্নার) এলোকেট করে তাকে সেখানে বসিয়ে রাখুন – তার সাথে কথা বার্তা বন্ধ। শাস্তি শেষে তার সাথে আবার ভালো ব্যাবহার করুন। দেখবেন সে বুঝে যাবে কোনটা আপনারা পছন্দ করছেন, কোনটা করছেন না।
(১৫) আপনার বাচ্চাকে কল্যানকর কিছুতে ইনভল্ভ করে দিন যেমনঃ খেলাধুলা, সমাজসেবা (এতিমখানা, পথশিশু, ভলান্টিয়ারিং, ইত্যাদি) বা ক্রিয়েটিভ কিছু (আঁকাআকি, লেখালেখি, কোডিং, বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি, ইত্যাদি)। ভালো মনে করলে, অনলাইনে কুরআন শিক্ষা বা ধর্মীয় শিক্ষা নিতে পারে। এতে করে সে অকল্যানকর জিনিষ থেকে দূরে থাকবে।
(১৬) ছোটবেলা থেকেই আপনার বাচ্চাকে ক্যারিয়ারিস্টিক হতে শেখান। পড়াশোনায় ভালো করলে পুরস্কৃত করুন। আপনার কথা শুনলে পুরস্কৃত করুন। ভালো বন্ধু বা বাচ্চাদের সংস্পর্শে রাখুন। দেখবেন বাচ্চা খুব ভালো হয়ে বড় হচ্ছে।
(১৭) ইন্টারনেটের কল্যানে ওয়েস্টার্ন মিডিয়া বা ভারতীয় মিডিয়ার (এমনকি এখন বাংলাদেশের মিডিয়া) কারনে অনেক বাচ্চাই মনে করতে পারে উচ্ছৃঙ্খলতা নরমাল, উগ্র পোশাক নরমাল, মদ খাওয়া, গাঁজা খাওয়া নরমাল, ডেটিং বা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক নরমাল, ইত্যাদি। তাদেরকে বোঝান যে এসব ধার্মিকদের ক্ষেত্রে মোটেই নরমাল নয়। তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দিন বা স্বশিক্ষিত করে গড়ে তুলুন, ইনশাল্লাহ তারা সব ধরনের বাজে কাজ থেকে দূরে থাকবে।
সবচেয়ে বড় কথা আপনার বাচ্চাকে ভালোবাসুন, তাকে সময় দিন ও তাকে জানান যে আপনি তাকে ভালোবাসেন। ভালোবাসা প্রকাশ করাও অত্যন্ত জরুরী !! তার সাথে বন্ধুত্ব করুন যাতে সে তার জীবনের সমস্ত ঘটনা আপনার সাথে শেয়ার করে। তার জীবনের সমস্ত ছোট-বড় ঘটনায় আপনি শামিল হোন। তবে অনেক ধরনের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।
মোল্লা মো. রাশিদুল হক
লেখক: রিসার্চ ফেলো, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়।